অনলাইন বইপঠনের জগতে যুক্তরাষ্ট্রে কিন্ডলের দাপট সর্বময়, বাকি বিশ্বেও যথেষ্ট। সেই আমাজন কিন্ডল-এ অতি সম্প্রতি বাংলা বই বিক্রির একটি উদ্যোগ চালু হল। বাংলাভাষার অনলাইন প্রকাশনায় এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই উদ্যোগে বর্তমানে কিন্ডল-এ ৩০টি বই পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের আনিসুল হক, পশ্চিমবঙ্গের আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত অমর মিত্রের মতো বাঘা বাঘা লেখকদের বই এই তালিকাভুক্ত।
ডিজিটাল প্রযুক্তি, প্রকাশনা আর বাংলা ভাষার ভবিষ্যতের এ এক জটিল সন্ধিক্ষণ। আমরা বাংলাভাষা প্রেমীরা কিন্তু বড্ড সেকেলে। বাংলা সাহিত্যের কথা ভাবলেই, আমরা ঢাকা বা কলকাতার বইমেলার স্মৃতিতে কাতর হই। ছাপা বই হাতে নেবার মজাই আলাদা। সেখানে কোথাকার কোন অশরীরী ডিজিটাল হরফ দিয়ে তৈরি বই, তাতে কি আর সেই আনন্দ আছে?
অথচ আসল কথা হচ্ছে বাংলা প্রকাশনাকে ডিজিটাল জমানার উপযোগী করে তোলা যুগের জরুরি দাবি। এই কাজটি করতেই ‘বইয়ের হাট’ কোমর বেঁধে নেমছে। দেড় লক্ষাধিক বাংলা বইপ্রেমীর পরিবার নিয়ে গঠিত ফেসবুক গ্রুপ ‘বইয়ের হাট’ ২০১২ সালে শুরু করেন আটলান্টা প্রবাসী বাংলাদেশি রিটন খান। বয়স সবে চল্লিশ পেরিয়েছে, রক্তে বইয়ের নেশা। ‘বইয়ের হাট’-এর ভৌগলিক ঠিকানা দেয়া সহজ নয়। বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এর অনুরাগী সদস্য, এর এডমিনরা কাজ করেন ঢাকা, কলকাতা, মুম্বাই থেকে। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না– ‘বইয়ের হাট’-এ রয়েছে ৪০০০ বিনামূল্যে লভ্য অনলাইন বাংলা বইয়ের সম্ভার।
রিটন চাইছেন আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে। ‘আমাজন ই-বুকের সমাজটা এত বিশাল, সেখানে বাংলার অনুপস্থিতি আমাকে খুব পীড়া দেয়,’ রিটন আমায় বললেন।
দুই বছর আগে রিটন আবিষ্কার করেন আমাজন কিন্ডল বাংলাভাষাকে সহায়তা করেনা। ভারতে কিন্ডল হিন্দি, গুজরাতি, মালায়লম সাহায্য করে, কিন্তু বাংলাকে সাহায্য করেনা। রিটন কিন্ডল কর্মকর্তাদের ধর্না দিলেন। তাদের চাঁছাছোলা ব্যবসায়িক প্রতিক্রিয়া হলো, বাংলা বইয়ের কোন চাহিদা নেই, তাই বাংলা বই নিয়ে ওদের মাথাব্যথাও নেই।
অর্থাৎ যুক্তির এক অদ্ভুত বদ্ধ গোলকধাঁধা। বাংলা বই কিন্ডল-এ নেই, তাই বাংলা বইয়ের চাহিদা নেই। বাংলা বইয়ের চাহিদা নেই, তাই কিন্ডল-এ বাংলা বই নেই।
তাই বলে রিটন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার পাত্র নয়। পেশায় তিনি স্বাস্থ্যসেবার তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, তাই কিন্ডল-এ বাংলা ব্যবহারের তথ্যপ্রযুক্তির ঝামেলা আগে সামাল দিলেন। এরপর কয়েক মাস আগে ইউনিকোড বাংলা ফন্ট ব্যবহার করে কিন্ডল-এ পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি বাংলা বই ছাড়লেন। সব ঠিকঠাক মতো চললো।
এবার রিটন পাকাপাকিভাবে এই কাজে মনোনিবেশ করলেন। ‘বইয়ের হাট পাবলিকেশনস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে নিবন্ধিত করে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাজন-এ প্রকাশনা সহযোগী হিসেবে যোগ দিলেন। তারপর ঢাকা আর কলকাতার লেখকদের সাথে বই প্রকাশ নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। রিটন বলেন, এই কাজের মূল উদ্দেশ্য প্রকাশনাকে লেখকদের আর্থিকভাবে ফলপ্রসূ করে তোলা। রিটন লেখকদের সরাসরি কিন্ডল-এ প্রকাশিত বইয়ের বিক্রয়মূল্যের ৩০% সম্মানী দিচ্ছেন। এ এক উদার, দুঃসাহসী পদক্ষেপ। কারণ নবীন এই অনলাইন বাংলা বই বিক্রির প্রকল্প জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে বইয়ের দাম অত্যন্ত সুলভ রাখা হয়েছে। কিছু কিছু বইয়ের দাম ২ ডলার। অত কম দামে বিক্রি করলে আমাজন নিজেই বিক্রিত অর্থের ৭০% রেখে দেয়।
রিটন বলেন কুছ পরোয়া নহী। টাকা বানাবার জন্য তো আর এই পথে আসেনি। বইয়ের প্রতি রিটনের ভালোবাসা লায়লি-মজনু, শিরি-ফরহাদের গল্পকেও হার মানায়। ওর লক্ষ্য আরও বিস্তৃত, মহৎ। ওনি চাইছে ডিজিটাল প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা প্রকাশনা শিল্পের সর্বনাশ ঠেকাতে। ‘বইয়ের হাট’ তার উদ্দেশ্য হিসেবে জানাচ্ছে:
‘বইয়ের হাট’-এর সূত্রপাত একটি সরল ভাবনা থেকে। ডিজিটাল জমানা বইয়ের প্রচার-প্রসারে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। বহু উন্নত দেশ এই ডিজিটাল মাধ্যমের সোয়ার হয়েছে, আর ই-বইয়ের ফলে বইয়ের প্রসার বহুগুণ বেড়েছে। এই সুযোগ গ্রহণ করতে বাংলা বই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে বিশ্বের আনাচে কানাচে বাংলা বই সহজলভ্য করে দেব।’
‘বইয়ের হাট’ এ বই নিয়ে প্রতিদিন কত রকমের অনবদ্য আলোচনা হয়! ‘বইয়ের হাট’ মাল্টিমিডিয়াতে রয়েছে লেখকদের ভিডিও সাক্ষাৎকার, এছাড়াও রয়েছে পডকাস্ট।
মোদ্দা কথাটা হচ্ছে বাংলা প্রকাশনা জগতের আজ অবধি আর্থিকভাবে ফলপ্রসূ ডিজিটাল প্রকাশনায় উত্তরণ ঘটেনি। আর এই অবস্থাটা এমন সময়ে ঘটছে, যখন অন্তত বাংলাদেশে বাংলা প্রকাশনা গভীর সঙ্কটে রয়েছে।
রিটন বলেন, লেখকদের আর্থিকভাবে লাভবান না করতে পারলে সাহিত্য মরে যাবে। বাংলাদেশ আর পশ্চিবঙ্গের লেখকের কাছ থেকে দারুন সাড়া পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশের হাসান আজিজুল হক ও তানভীর মোকাম্মেল, পশ্চিমবঙ্গে বাণী বসু ও মিহির সেনগুপ্তের বই প্রকাশনা নিয়ে কথাবার্তা চলছে।
All rights reserved © Use of website without any written permission illegal
Leave a Reply